December 23, 2024, 3:06 am

রহস্যময় তখতে সুলাইমানের ইতিকথা।

অনলাইন ডেক্স
  • Update Time : Monday, December 19, 2022,
  • 53 Time View

বহু ইতিহাস, উপাখ্যান ও রূপকথার সাক্ষী ইরানের তখতে সুলাইমান। এটি মূলত ইরানের পশ্চিম আজারবাইজান প্রদেশে পাহাড়ের সুউচ্চ শৃঙ্গে অবস্থিত প্রাচীন দুর্গ, মন্দির ও মসজিদের ধ্বংসাবশেষ। প্রাচীন পারস্য অঞ্চলে রাজত্বকারী কয়েকটি রাজবংশ ও প্রচলিত ধর্মমতের স্মৃতিচিহ্ন বহন করছে এই প্রত্নতাত্ত্বিক অঞ্চল। তখতে সুলাইমানের আয়তন প্রায় ২০ লাখ ৭০ হাজার বর্গফুট।

 

ফারসি ‘তখতে সুলাইমান’ অর্থ সুলাইমানের সিংহাসন। প্রাচীন ইরানি সাহিত্যে দাবি করা হয়েছে, এখানে সর্বপ্রথম দুর্গ গড়ে তোলেন নবী সুলাইমান (আ.)। পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত একটি গভীর সুরঙ্গকে ইরানিরা ‘জিন্দানে সুলাইমান’ বা সুলাইমানের জেলখানা আখ্যা দেয়। বলা হয়, এখানে তিনি অবাধ্য ও দুষ্টু জিনদের বন্দি করে রাখতেন। জুলাই ২০০৩ সালে ইউনেসকো তখতে সুলাইমানকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ ঘোষণা করে।

ধর্ম ও সভ্যতার মিলনস্থল : ‘তখতে সুলাইমান’ নামটিই ইঙ্গিত করে কোরআন ও বাইবেলে উদ্ধৃত নবী ও শাসক সুলাইমান (আ.) জড়িয়ে আছেন এই পাহাড়ের সঙ্গে। ইরানি উপাখ্যান অনুযায়ী এখানের একটি ভূগর্ভস্থ জেলখানায় সুলাইমান (আ.) দুষ্টু জিনদের বন্দি করে রাখতেন এবং তাঁর অবাধ্য জিনরাই এখানে গভীর হ্রদ সৃষ্টি করে তাকে জাদুকরি আংটি নিক্ষেপ করে। এখানে অবস্থিত হ্রদের নিচে আছে গোপন ধনভাণ্ডার, জরথ্রুস্ট ধর্মের অনুসারীরা বিশ্বাস করেন তাদের ধর্মাবতার জরুসথার এখানে জন্মগ্রহণ করেন, আর্থুরিয়ান সাহিত্যের অমরত্ব দানকারী ‘দ্য হোলি গ্রিল’ এখানের হ্রদে প্রোথিত আছে বলে কথিত আছে। এ ছাড়া এখানে খুঁজে পাওয়া গেছে প্রাচীন পারস্যের জনপ্রিয় দেবী আনাহিতার মন্দির ও সানানি সম্রাটদের প্রধান অগ্নি মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ।

যা আছে তখতে সুলাইমানিতে

তখতে সুলাইমান খনন করে প্রত্নতাত্ত্বিকরা বিভিন্ন যুগের ঐতিহাসিক নিদর্শন খুঁজে পেয়েছেন। সর্বপ্রাচীন নিদর্শনটি হচ্ছে খ্রিস্টপূর্ব পাঁচ শ বছর আগের ‘আর্চেমেনীয়’ আমলের। এখানে পার্সিয়ান সাম্রাজ্যের দুর্গ ছিল। গবেষকরা এখানে সাসানি আমলের কিছু মুদ্রা এবং বাইজাইন্টাইন সম্রাট দ্বিতীয় থিয়োডিয়াসের যুগের কিছু নিদর্শন পেয়েছেন। অর্থাৎ এই পর্বতশৃঙ্গে অবস্থিত প্রতিটি স্থাপনাই ইতিহাসের একেক সময় নির্মিত এবং প্রতিটির গল্পই অন্যটি থেকে ভিন্ন। পর্যটকদের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় এখানের নীল পানির গভীর হ্রদটি।

১.   সম্রাট খসরুর রাজকীয় সভাকক্ষ : এটি কমপ্লেক্সের উত্তর-পশ্চিম অংশে অবস্থিত একটি রাজকীয় সভাকক্ষের অংশ। সানানীয় সম্রাটরা এখানে অবস্থান করে জরথ্রুস্ট ধর্মের অগ্নি মন্দিরের পূজা-অর্চনা দেখতেন। এটি তৈরি করা হয়েছিল সম্রাট প্রথম খসরুর জন্য। যাকে আনোসিরভানে সাসানি বলা হতো।

২.   আজারগোসনাসব অগ্নি মন্দির : আজারগোসনাসব অর্থ পুরুষ ঘোড়া। সম্ভবত রাজকীয় শক্তির প্রতীক হিসেবে পুরুষ ঘোড়ার নামে মন্দিরের নামকরণ করা হয়েছিল। এখানে জরথ্রুস্ট ধর্মের অনুসারীরা তাদের পবিত্র আগুন রেখেছিল। ঐতিহাসিক বর্ণনা অনুসারে, মন্দিরের দেয়াল গ্রহ, নক্ষত্র, প্রাণী, উদ্ভিদ ও কিছু অদ্ভূত অবয়বের দেব-দেবীর ছবিতে ভরপুর ছিল। মন্দিরের আগুন প্রায় সাত শ বছর পর্যন্ত প্রজ্বলিত ছিল। বলা হতো, এই আগুনের কোনো ছাই নেই। আরব মুসলিমরা পারস্য জয় করার পর এখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছিল।

৩.   জিন্দানে সুলাইমান : জিন্দানে সুলাইমানি হলো একটি শঙ্কু আকৃতির আগ্নেগিরি সদৃশ পর্বতশৃঙ্গ। যার উচ্চতা ১০১ মিটার এবং তা তখতে সুলাইমান থেকে তিন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। পর্বতশৃঙ্গের ঠিক কেন্দ্রে ৬৫ মিটার ব্যাসের গর্ত আছে। ঠিক তার পাশেই আছে খ্রিস্টপূর্ব এক হাজার বছর আগের প্রাচীন মন্দির। লোককথা অনুসারে এটা সুলাইমান (আ.)-এর জেলখানা ছিল। যেখানে তিনি দুষ্টু জিনদের বন্দি রাখতেন।

৪.   আনাহিতা মন্দির : পৌরাণিক দেবী আনাহিতার একটি মন্দিরও আছে তখতে সুলাইমানে। প্রাচীন পারস্যবাসী আনাহিতাকে পানি, ভালোবাসা ও প্রাচুর্যের দেবী হিসেবে উপাসনা করত। ইরানের প্রাচীন শহরগুলোর বেশির ভাগেই আনাহিতা দেবীর মন্দির পাওয়া যায় এবং সেগুলো জলাধারের খুব নিকটে অবস্থিত।

৫.   সুলাইমানের রহস্যময় হ্রদ : পাহাড়ের এত উঁচুতে কিভাবে হ্রদের সৃষ্টি হলো তা সত্যিই রহস্যজনক। হ্রদের আয়তন প্রায় এক লাখ বর্গ ফিট। ধারণা করা হয়, ডিম্বাকৃতির হ্রদটি ঘিরে গড়ে উঠেছিল ঐতিহাসিক এসব স্থাপনা। বিস্ময়কর বিষয় হলো হ্রদের পানির তাপমাত্রা কখনো পরিবর্তন হয় না। হ্রদটি তৈরি হয়েছে একটি পাহাড়ি ঝরনা থেকে। কিন্তু স্থির একটি হ্রদের গভীরতা এত বেশি কিভাবে হলো তারও কোনো সঠিক ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায় না। হ্রদের তীরবর্তী অঞ্চলেও এর গভীরতা ৪০ থেকে ৪৫ মিটার। এর গড় গভীরতা ২৩০ ফিট এবং সর্বোচ্চ গভীরতা ৪০০ ফিট। হ্রদের পানির বৈশিষ্ট্যের কারণে এখানে কোনো প্রাণী বাঁচে না বা উদ্ভিদ জন্মায় না।

হ্রদের সৃষ্টি ও তা নিয়ে স্থানীয়দের ভেতর বিভিন্ন মিথ আছে। যেমন বলা হয়, হ্রদটি সুলাইমান (আ.)-এর লাঠির আঘাতে তৈরি হয়েছিল। কেউ কেউ বলেন, সুলাইমান (আ.)-এর জাদুকরি আংটি চুরি করার পর জিনরা হ্রদ সৃষ্টি করে তা এখানে নিক্ষেপ করেছিল। সেই আংটি তিনি আর কখনো খুঁজে পাননি। তাঁর আংটির প্রভাবেই হ্রদের পানি এত ভারী ও এর ঘনত্ব এত বেশি। অন্যরা বলেন, সাইরাস দ্য গ্রেট বা আর্চেমেনীয় সম্রাট দ্বিতীয় সাইরাস রাজা ক্রোয়েসাসকে পরাজিত করার পর তাঁর সমুদয় সম্পদ এই হ্রদে নিক্ষেপ করার নির্দেশ দেন।

যেভাবে ধ্বংস হয় : ৬২৩ খ্রিস্টাব্দে বাইজাইন্টাইন বাহিনী এই অঞ্চল জয় করার পর তারা উপাসনালয়গুলো ভাঙচুর ও ক্ষতিগ্রস্ত করে। এরপর তা মুসলিমদের দখলে আসে। মুসলমান জরথ্রুস্টদের ধর্মপালনের সুযোগ দেয় এবং খ্রিস্টীয় দশম শতক (আনুমানিক) তা অব্যাহত ছিল। সম্ভবত এরপর জরথ্রুস্টদের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ায় মন্দিরগুলো পরিত্যক্ত হয়। ১৩ শতকে মোঙ্গলীয় বাহিনী এই অঞ্চল দখল করে এবং তখতে সুলাইমানে নতুন নতুন স্থাপনা তৈরি করে। তারা প্রাকইসলামী যুগের কিছু স্থাপনা সংস্কারও করে। ১৪ শতকের মাঝামাঝি মোঙ্গলীয়রা তখতে সুলাইমান ত্যাগ করলে স্থানটি জনবসতিহীন হয়ে পড়ে।

তথ্যঋণ : আপোচি ডটকম, ব্রিটানিকা ডটকম ও ইউনেসকো ডটঅর্গ

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
© All rights reserved © 2024
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: রায়তা-হোস্ট
tmnews71